
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রানের অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক, মহান মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন সমন্বয়ে গঠিও যৌথ গেরিলা বাহিনীর বনগা ক্যাম্প ইনচার্জ। রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়াডের নির্মম নির্যাতনের সাক্ষী আন্দামান ফোরাত বন্দি, ৩১ বছর কারাবরণকারী, অকৃতদার, সৎ প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ কমরেড আশু ভরদ্বাজ এর আজ ১৫ এপ্রিল ৩২তম মৃত্যু বার্ষিকীতে আনাচ্ছি গভীর শ্রদ্ধা ও সাল সালাম । গোপালগঞ্জের জন্মগ্রহণকারী আশু ভরদ্বাজ জেলখানার বাইরে রাজবাড়ীতে জীবনের বেশির ভাগ সময় থেকেছেন। জাতীয় রাজনীতিতে বিচরণ থাকলেও কর্মক্ষেত্র ছিল বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা। ১৯২০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানার উনশিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে আশু ভরদ্বাজ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম উমাঅচরণ ভরদ্বাজ জোতিভূষণ, মাতা অন্নদা সুন্দরী দেবী। চার সন্তানের মধ্যে তিনি দিলেন তৃতীয়। ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান হিসেবে তাকে টোলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য টোল থেকে পণ্ডিত হয়ে বের হবেন এবং পারিবারিক ঐতিহা বজায় রাখবেন। কিন্তু টোলের শিক্ষা তার পছন্দ হয়নি। তিনি টোল ছেড়ে দেন এবং পরিবারকে স্কুলে ভর্তি করে দেবার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। স্কুলের শিক্ষা বিজাতীয় এই ধারণার বশবর্তী হয়ে পরিবার প্রথমে তাকে স্কুলে ভর্তি করাতে চায়নি। পরবর্তীতে তার পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে তাকে ১৯২৬ সালে পচাগড়া স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। এ স্কুলে তিনি এক বছর অধ্যয়ন করেন। যোগাযোগ খারাপ হওয়ার কারণে তাকে কোটালীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হতে হয়। এটা ১৯২৮-৭৯ সালের কথা, তখন সারা ভারতবর্ষ জুড়ে কংগ্রেসের আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এ ঢেউ এসে কোটালীপাড়ায়ও লাগে। তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কংগ্রেসের হয়ে কাজ করতে শুরু করেন। বিলেতি দ্রব্য বর্জন ও অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে তিনি ১৯৩০ প্রথম গ্রেফতার হন এবং একদিন হাজতবাস করেন। কংগ্রেদের আন্দোলন যখন তীব্রতার হচ্ছিল তখন তিনি কংগ্রেস সত্যাগ্রহ যোষণা করেন ।যার মূলনীতি ছিল, মার খেয়ে স্থান ত্যাগ না করা এবং হিংসার আশ্রয় না নেওয়া। এই নীতির সম্মান দেখাতে গিয়ে তিনি পুলিশের হাতে চরম মার খান। ফলশ্রুতিতে কংগ্রেসের রাজনীতির প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। এ সময় তিনি কংগ্রেস ছেড়ে দিয়ে অনুশীলন পার্টিতে যোগ দেন। অনুশীলন পাটি পড়ে পড়ে মার খাওয়ার বিরোধিতা করেন। তারা সহিংস আন্দোলনের পক্ষে ছিল। তারা পাঠাগার, ক্লাব, শরীরচর্চা, বইপড়া, অস্ত্র চালনা প্রভৃতির মাধ্যমে তাদের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে। আশু ভরদ্বাজ অনুশীলন পার্টিতে নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ পান। অনুশীলন পাটির হয়ে তিনি সক্রিয়ভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন। এসময় অনুশীলন পার্টি সরকারের রোষানলে পড়ে। সরকার গোয়েন্দাদের মাধ্যমে অনুশীলন পার্টির সদসদের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের গ্রেফতার করতে শুরু করে। পার্টি এ সময় সিদ্ধান্ত নেয় সরকারের হয়ে গোয়েন্দাগিরিরত বাক্তিদের হত্যা করার। ও দায়িত্বে আশুভরদ্বাজসহ অপর দুইজন কমরেডের ওপর ন্যাস্ত হয়। তারা গোয়ালন্দের গোয়েন্দাদের চর কালীপদ ঠাকুরকে হত্যা করতে হত্যা করতে সমর্থ হয়। এ ঘটনার পর ৭২ জন কমরেডের সাথে তাকেও গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর ৭ দিন আটকে রেখে তার ওপর পুলিশ বর্বর নির্যাতন চালায়। ১৯৩৫ সাল ফরিদপুর জজকোটে স্পেশাল ট্রাইবুনালে তার বিচার হয়। বিচারে তাকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু বয়স কম হওয়ার কারণে বিচারক ফাঁসির দণ্ডাদেশ মওকুফ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও দ্বীপান্তরের আদেশ দেন। তিনি ফরিদপুর, ঢাকা, দমদম, আলীপুর সর্বশেষ আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের জেলে সাধারণ কয়েদি হিসেবে জেল জীবন ভোগ করেন।জেলে অন্যান্য বন্দিদের সাথে একত্রে রাজবন্দি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আন্দোলন করেন। এখানে আন্দোলনের অংশ হিসেবে সর্বোচ্চ ৫১ দিন অনশন ধর্মঘট করে রাজবন্দির মর্যাদা আদায়ে সক্ষম হন। জেলে থাকাকালীন সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং শেষ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করে সারা বিশ্বেই সমাজতন্ত্র জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে এবং বিশ্বের কয়েকটি দেশে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসে। এর ঢেউ এসে জেলখানায়ও লাগে। জেলখানায় রাজবন্দিরা রুশ বিপ্লবের ওপর বই পাঠ এবং আলোচনা করতে থাকেন। অনেকেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। এখানে গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রম শুরু হয়। এতে তিনিও এর নাথে যুক্ত হন। তিনি বইপত্র পড়ার মাধ্যমে নিজেকে সমৃদ্ধ করেন। এছাড়া সর্তীথ রাজবন্দিদের সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠে। অনিল মুখার্জি, নলিনী দাস, ডাক্তার নারায়ণ রায়, হরিপদ চৌধুরী, বলেশ্বর রায় প্রমুখ তাদের মধ্যে কয়েকজন। ওছাড়াও তাদের মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন সময় কারাগারে গিয়ে দেখা করেন নেভাজী সুভাষচন্দ্র বোস ,সোমনাথ লাহেডি, মোজাফফর অমেম্মদ (কাকা বাবু) রবি সেন প্রমুখ। তাদের মুক্তির দাবিতে কবিগুরু বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী প্রমুখ বিবৃতি দেন। ১৯৪৬ সালে তিনি জেল থেকে সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পান । মুক্তির পর তিনি ফরিদপুর চলে আসেন এবং ফরিদপুর কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন। পার্টি তাকে রেল শ্রমিকদের সংঘটিত করার জন্য রাজবাড়ীতে প্রেরণ করে। তিনি রাজবাড়ী চলে আসেন এবং তিনি ইবি রোডস ওয়ার্কার ইউনিয়নের পক্ষে কাজ করতে শুরু করেন। এছাড়ার পদ্মা বিধৌত এ অঞ্চলের অবহেলিত মৎস্যজীবীদের সংঘটিত করার লক্ষ্যে পদ্মা মৎস্যজীবী সমিতি গড়ে তোলেন। এছাড়াও তিনি বিড়ি শ্রমিকদেরও সংঘটিত করেন এবং তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনা করেন। রেল শ্রমিকদের এবং পদ্মা মৎস্যজীবী সমিতির আন্দোলনে কমরেড জ্যোতি বসু ,কমরেড মহম্মদ ইসমাইল যুক্ত ছিলেন। তারা রাজবাড়ীতে আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেন। এ সময় কমরেড মুজাফফর আহম্মেদ (কাকা বাবু) এবং জ্যোতি বসু পার্টির কাজে রাজবাড়ীতে কয়েকবার আসেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর হিন্দুদের মধ্যে যখন দেশ ত্যাগের প্রবল হিড়িক দেখা দেয় তখন তিনি একজন প্রকৃত দেশ প্রেমিকের মত কমরেড জ্যোতি বসু, কমরেড মহম্মদ ইসমাইলকে সঙ্গে নিয়ে জনসভা-সমাবেশের মাধ্যনে দেশ না ছাড়ার জন্য হিন্দুদের উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। ১৯৫৪ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড সংঘটিও হয়। ৭ জন কমরেড পুলিশের ওলিতে নিহত হন। এ সময় তিমি খাপড়া ওয়ার্ড বন্দি ছিলেন । তিনি গুলি প্রতিরোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে জানালা দিয়ে গুলি করা হচ্ছিল তা বন্ধ করতে যান এবং নিশ্চিত মৃত্যু থেকে প্রাণে রক্ষা পান। খাপড়া ওয়ার্ডের হত্যাকাণ্ডের স্মৃতির সাথে আজও তার নাম জড়িতে আছে। ১৯৫৫ সালে জেল থেকে মুক্তি লাভ করার মাত্র ৪০ দিন পর
ধর্মঘটে মদদ দেওয়ার অভিযোগে আবার তিনি গ্রেফতার হন। এরপর ১৯৬৮, ৬৯ এর আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে বিষের ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি ম্যাপ কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে অংশ নেন ৭০ এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি বাহিনী এদেশের মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে রাজনীতি যে সর্বদলীয় প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয় তিনি তার সদস্য ছিলেন। রাজবাড়ী শত্রুদের কবলে চলে যাবার পর তিনি দেশ ত্যাগ করে ভারতে গমন করেন এবং ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের সহযোগে গঠিত যৌথ গেরিলা বাহিনী গঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
বনগাঁ ক্যাম্পের তিনি ক্যাম্প ইনচার্জ হিসেবে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে দেশে ফিরে দেশেরপুনর্বাসন -পূর্নগঠন কাজে অংশগ্রহণ করেন। ‘৭৩-এর সাধারণ নিৰ্বাচনে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে অংশ নেন। ১৯৬৮ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত কমরেড আশু ভরদ্বাজ ফরিদপুর জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৩ সালের ১৬ এপ্রিল প্রথম প্রহরে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কমরেড আশু জরদ্বাজ পার্টির প্রতি ছিলেন নিবেদিত্ত প্রাণ অবিচল দৃঢ়। তিনি কখনও পার্টির সিদ্ধান্তের বাইরে যান নি। এমনকি পার্টির কোন সিদ্ধান্ত তার মনোপুত না হলেও তিনি তা বাস্তবায়নে দৃঢ় থেকেছেন। কমরেড আশু ভরদ্বাজ ছিলেন স্ব-শাসান বিশ্বাসী। তিনি মনের অজান্তে কোনো অপরাধ করলে নিজেই তার শাস্তির ব্যবস্থা করতেন। শাস্তির মধ্যে ছিল না খেয়ে থাকা, মাথার চুল টেনে ছেড়া ও নস্যি ব্যবহার না করা ইত্যাদি। তিনি ছিলেন চিরকুমার। কমরেড আশু ভরদ্বাজ সকলের প্রিয় আশুদা। আশুগা নামেই সকলে তাকে ডাকতেন। মাসে এক কৌটা নস্যি ব্যবহার করতেন তিনি। এটা দিল তার স্ববরাদ্দ ছিল।এক মাসের আগে নস্যি ফুরিয়ে গেলে বাকি ক’দিন নস্যিব ব্যবহার করতেন না। বিয়ে করেন নি কেন এ কথা কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি হাসিমুখে বলতেন, ‘সময় পেলাম কোথায়। জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলিই তো জেলে কাটালাম। সমাজতন্ত্র হলো না. কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় যেতে পারল না, এতে কি বোঝা যায় না আপনার রাজনৈতিক জীবন ব্যর্থ? এ প্রশ্নের জবাবে স্বহাস্যে উত্তর দিতেন দৃঢ়তার সঙ্গে- ‘না, ব্যর্থ না। ধর একটা বড় ইমারত তৈরি করতে অনেক ইটের প্রয়োজন। সেই ইমরাত তৈরি করতে আমি কিছু ইট গেঁথেছি। ভবিষ্যত প্রজন্ম ইমারতটি নির্মাণ সম্পন্ন করবে। তাই আমি বা পার্টি ব্যর্থ হয়নি। মার্কসবাদ একটা বিজ্ঞান, বিজ্ঞান ব্যর্থ হতে পারে না। সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ একদিন প্রতিষ্ঠা হবেই হবে। তিয়াত্তর বছরের সংগ্রামী জীবনের একত্রিশ বছর জেলে কাটিযোগেন। শত জুলুম নির্যাতন সহ্য করে শ্রমিক কৃষক-মেহনতি মানুদের মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করে তিনি অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন । মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী অগ্নিযুগের বিপ্লবী মৃত্যুঞ্জয়ী কমরেড আশু ভরদ্বাজ-লাল মালাম।
।। আবুল কালাম।।
