রাজবাড়ী ১১:৩৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বাংলা আমার মায়ের ভাষা

আশিক হাসান সীমান্ত

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জন্মের আগেই এ অঞ্চলের যুবসমাজ নিজেদের অধিকার রক্ষার চিন্তা করতে শুরু করে। সেই চিন্তা থেকেই বৈঠক। প্রথম বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববঙ্গের অসাম্প্রদায়িক যুব সম্প্রদায়ের সম্মেলন ডাকতে হবে। কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলের একটি কক্ষে এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন-কাজী ইদ্রিস, শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, রাজশাহীর আতাউর রহমান, আখলাকুর রহমান আরও কয়েকজন।

১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত জনসভায় গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’

শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমরা প্রায় চার-পাঁচশ ছাত্র এক জায়গায় ছিলাম সে সভায়। অনেকে হাত তুলে জানিয়ে দিলো মানি না, মানি না। ২৪ মার্চ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে বক্তৃতা করতে উঠে তিনি যখন আবার বললেন, ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’ তখন ছাত্ররা তার সামনেই বসে চিৎকার করে বলল, ‘না, না, না।’ জিন্নাহ প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করেছিলেন, তারপর পুনরায় বক্তৃৃতা করেন। আমার মনে হয়, এই প্রথম তার মুখের ওপরে তার কথার প্রতিবাদ করল বাংলার ছাত্ররা। এরপর জিন্নাহ যতদিন বেঁচেছিলেন, আর কোনো দিন বলেন নাই, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।’

১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সভায় ছাত্রনেতা শেখ মুজিব সাহসী কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘সরকার কি আপসের প্রস্তাব দিয়েছে? নাজিমুদ্দিন সরকার কি বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিয়েছে? যদি তা না হয়ে থাকে তবে আগামীকাল ধর্মঘট হবে, সেক্রেটারিয়েটের সামনে পিকেটিং হবে। ছাত্রনেতা শেখ মুজিবকে সমর্থন দিলেন অলি আহাদ, তোয়াহা, মোগলটুলীর শওকত সাহেব, শামসুল হক সাহেব। ১১ মার্চ হরতাল হরতালে ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হন, তার অপর সাথী অলি আহাদ, শামসুল হক সাহেব, শওকত সাহেব এবং অন্যদের সঙ্গে।

মুজিব তখন কারাগারে। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট হয়। জেল থেকে শেখ মুজিব-খবর পাঠিয়ে সমর্থন জানান একুশের দেশব্যাপী হরতালের প্রতি। তিনি বাংলা ভাষার প্রতি সমর্থন জানিয়ে আইনসভার সদস্যদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হবে এটাও বলেন। আরও বলেন তিনি এবং মহিউদ্দিন সাহেব রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে অনশন করবেন। একুশে ফেব্রুয়ারি হরতাল হবে।

বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লেখেন, ‘মুসলিম লীগ সরকার কত বড় অপরিণামদর্শিতার কাজ করল। মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয় নাই। …আমি ভাবলাম, দেখব কি না জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে উপায় নাই।’ অবশেষে ২৭ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির ঘোষণা দিয়ে অনশন ভঙ্গ করানো হয়।

জেল থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ছাত্রলীগকে অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের নির্দেশ দিলেন। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ তার ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগে পরিণত হয়।

২৭ এপ্রিল ১৯৫২ তারিখে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জেলা ও মহকুমা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আতাউর রহমান খান ওই সভায় সভাপতিত্ব করার সময় অসুস্থতাবশত একপর্যায়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। এ পর্যায়ে সভাপতির লিখিত ভাষণ পাঠ করেন কামরুদ্দিন আহমদ। আর আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনেও বঙ্গবন্ধুর যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেন। সেদিন সব আন্দোলন, মিছিল এবং নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন তিনি। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্ট প্রণীত ২১ দফার প্রথম দফা ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ ১৯৫৬ সালের ১৭ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আইন পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু সংসদের দৈনন্দিন কার্যসূচি বাংলা ভাষায় মুদ্রণ করার দাবি জানান। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গৃহীত প্রথম সংবিধানে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান প্রণীত হয়। এই সংবিধানে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন।

১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেন। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করেন।

রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক জারিকৃত এক আদেশে বলা হয়, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা।

Tag :

বাংলা আমার মায়ের ভাষা

প্রকাশিত : ০২:১৪:৩৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

আশিক হাসান সীমান্ত

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জন্মের আগেই এ অঞ্চলের যুবসমাজ নিজেদের অধিকার রক্ষার চিন্তা করতে শুরু করে। সেই চিন্তা থেকেই বৈঠক। প্রথম বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববঙ্গের অসাম্প্রদায়িক যুব সম্প্রদায়ের সম্মেলন ডাকতে হবে। কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলের একটি কক্ষে এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন-কাজী ইদ্রিস, শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, রাজশাহীর আতাউর রহমান, আখলাকুর রহমান আরও কয়েকজন।

১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত জনসভায় গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’

শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমরা প্রায় চার-পাঁচশ ছাত্র এক জায়গায় ছিলাম সে সভায়। অনেকে হাত তুলে জানিয়ে দিলো মানি না, মানি না। ২৪ মার্চ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে বক্তৃতা করতে উঠে তিনি যখন আবার বললেন, ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’ তখন ছাত্ররা তার সামনেই বসে চিৎকার করে বলল, ‘না, না, না।’ জিন্নাহ প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করেছিলেন, তারপর পুনরায় বক্তৃৃতা করেন। আমার মনে হয়, এই প্রথম তার মুখের ওপরে তার কথার প্রতিবাদ করল বাংলার ছাত্ররা। এরপর জিন্নাহ যতদিন বেঁচেছিলেন, আর কোনো দিন বলেন নাই, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।’

১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সভায় ছাত্রনেতা শেখ মুজিব সাহসী কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘সরকার কি আপসের প্রস্তাব দিয়েছে? নাজিমুদ্দিন সরকার কি বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিয়েছে? যদি তা না হয়ে থাকে তবে আগামীকাল ধর্মঘট হবে, সেক্রেটারিয়েটের সামনে পিকেটিং হবে। ছাত্রনেতা শেখ মুজিবকে সমর্থন দিলেন অলি আহাদ, তোয়াহা, মোগলটুলীর শওকত সাহেব, শামসুল হক সাহেব। ১১ মার্চ হরতাল হরতালে ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হন, তার অপর সাথী অলি আহাদ, শামসুল হক সাহেব, শওকত সাহেব এবং অন্যদের সঙ্গে।

মুজিব তখন কারাগারে। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট হয়। জেল থেকে শেখ মুজিব-খবর পাঠিয়ে সমর্থন জানান একুশের দেশব্যাপী হরতালের প্রতি। তিনি বাংলা ভাষার প্রতি সমর্থন জানিয়ে আইনসভার সদস্যদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হবে এটাও বলেন। আরও বলেন তিনি এবং মহিউদ্দিন সাহেব রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে অনশন করবেন। একুশে ফেব্রুয়ারি হরতাল হবে।

বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লেখেন, ‘মুসলিম লীগ সরকার কত বড় অপরিণামদর্শিতার কাজ করল। মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয় নাই। …আমি ভাবলাম, দেখব কি না জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে উপায় নাই।’ অবশেষে ২৭ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির ঘোষণা দিয়ে অনশন ভঙ্গ করানো হয়।

জেল থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ছাত্রলীগকে অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের নির্দেশ দিলেন। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ তার ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগে পরিণত হয়।

২৭ এপ্রিল ১৯৫২ তারিখে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জেলা ও মহকুমা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আতাউর রহমান খান ওই সভায় সভাপতিত্ব করার সময় অসুস্থতাবশত একপর্যায়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। এ পর্যায়ে সভাপতির লিখিত ভাষণ পাঠ করেন কামরুদ্দিন আহমদ। আর আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনেও বঙ্গবন্ধুর যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেন। সেদিন সব আন্দোলন, মিছিল এবং নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন তিনি। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্ট প্রণীত ২১ দফার প্রথম দফা ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ ১৯৫৬ সালের ১৭ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আইন পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু সংসদের দৈনন্দিন কার্যসূচি বাংলা ভাষায় মুদ্রণ করার দাবি জানান। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গৃহীত প্রথম সংবিধানে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান প্রণীত হয়। এই সংবিধানে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন।

১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেন। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করেন।

রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক জারিকৃত এক আদেশে বলা হয়, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা।