
রাজবাড়ী কৃষি সময় ডেস্ক:
দেশের যে কোনো অঞ্চলের উৎপাদিত বীজের তুলনায় ফরিদপুরের পেঁয়াজ বীজ মানের দিক থেকে উৎকৃষ্টমানের। এ জেলার পেঁয়াজ বীজ দেশের ৭০ ভাগ চাহিদার জোগান দেয়। শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবারও এর বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা আছে। কয়েকদিন পরে চাষিরা ঘরে তুলবেন এই কালো সোনা। চলছে শেষ সময়ের পরিচর্যা আর প্রস্তুতি। তবে এবার মাঠে মৌমাছির আনাগোনা নেই বলে হাত দিয়ে পেঁয়াজ বীজের কদম পরাগায়ন করতে হয়েছে চাষিদের। এতে শ্রমিকের বাড়তি খরচ হলেও বেশি ফলনের আশাবাদী তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পেঁয়াজের বীজ চাষে মারাত্মক ঝুঁকি আছে। এর ভালো-মন্দ অনেকটাই নির্ভর করে আবহাওয়ার ওপর। এ বছর এখন পর্যন্ত আবহাওয়া ভালো থাকলেও কিছুটা সমস্যা হয়েছে মৌমাছি না আসায়। যে কারণে হাত দিয়ে পরাগায়ন করতে হচ্ছে। এতে শ্রমিকের মজুরি খরচ বাড়লেও দ্বিগুণ ফলনের সম্ভাবনা আছে।
কৃষি বিভাগ ও চাষিদের মতে, এটি ছোট্ট শিশুর মতো যত্ন করে লালন-পালন করতে হয়। মাঠ তৈরি থেকে শুরু করে পেঁয়াজ লাগানো, মাঠ পরিচর্যা, ফুল আসার পর কীটনাশক, সেচ দিতে হয় দফায় দফায়। পেঁয়াজের কদম থেকে বীজ ছাড়ানো এবং তা রোদে শুকিয়ে ধুয়ে ফের রোদে শুকানোর পর অতিযত্নে বস্তায় রাখা হয়। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটলে বীজ নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া ঘন কুয়াশা, অতিখরা, ঝড়-বৃষ্টি হলে পেঁয়াজ বীজ নষ্ট হয়। পেঁয়াজ বীজ আবাদে খরচও হয় প্রচুর। বেশি ঝুঁকি নিয়ে পেঁয়াজ বীজের আবাদ করেন চাষিরা। গত বছর একর প্রতি জমিতে খরচ হয়েছে দেড় লাখ টাকার মতো। প্রতি একরে গড়ে তিনশ কেজি বীজ পাওয়া গেছে। গত বছর মৌসুমের শুরুতে পেঁয়াজ বীজ বিক্রি হয়েছিল ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা কেজি দরে। এ বছর বীজের দাম কিছুটা বাড়বে বলে মনে করছেন চাষিরা।
একাধিক কৃষক ফরিদপুর প্রতিদিনকে জানান, বিভিন্ন ফসলি জমিতে পোকা দমনের ক্ষেত্রে নির্বিচারে ব্যবহার করা হয় কীটনাশক। ফলে উপকারী পোকা এবং মৌমাছি মারা যাচ্ছে। তাদের আগমন নেই। এজন্য প্রকৃতিনির্ভর পরাগায়ন ছেড়ে চাষিরা এখন কৃত্রিম পরাগায়ন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। হাত দিয়ে পরাগায়ন করা হচ্ছে। হাত দিয়ে পুরুষ ফুলের পরাগরেণু স্ত্রী ফুলের গর্ভমুখে স্থাপন করা হয়। এভাবে পরাগায়ন করলে সময় বেশি লাগে। তাই কৃষি বিভাগের পরামর্শে সাদা সুতি কাপড় (মার্কিন কাপড়) দিয়ে পরাগায়ন করছেন। কাপড়টি ক্ষেতের সব ফুলের ওপর দিয়ে আলতোভাবে টেনে নিতে হয়। এতেই ফুলের পরস্পরের স্পর্শে পরাগায়ন হয়ে যায়।
ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, জেলায় এ বছর ১ হাজার ৮৬৭ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ বীজের আবাদ করা হয়েছে। যার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৯৩৩ মেট্রিক টন বীজের। এবার যে ফলন দেখা যাচ্ছে, তা ভালোভাবে ঘরে তুলতে পারলে এবং বাজারদর ভালো পেলে তারা বেশ লাভবান হবেন। গত বছর বীজ বিক্রি করে কৃষকরা অনেকেই লাভবান হওয়ায় এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৫৩ হেক্টর বেশি জমিতে এর আবাদ করেছেন।
কৃত্রিম পরাগায়ন করা কৃষিশ্রমিক রুস্তম আলী, আকবর শেখ দৈনিক রাজবাড়ী সময় কে জানান, পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনে পরাগায়ন ঘটানোর জন্য অনেক মৌমাছির প্রয়োজন হয়। এবার তেমন মৌমাছি নেই। যার কারণে ভালো বীজ উৎপাদনের জন্য পেঁয়াজ ক্ষেতে পরাগায়নের কাজ করছেন তারা।
নগরকান্দার কৃষক জলিল শেখ ফরিদপুর প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের অসচেতনতা ও অবহেলার কারণে এসব উপকারী পোকামাকড় মারা যাচ্ছে। ফলে ফসলের পরাগায়নব্যবস্থা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। শুধু পেঁয়াজের বীজ ফুলের ক্ষেত্রেই নয়, এ সমস্যা অন্য ফসলের ক্ষেত্রেও ঘটছে।
দেশসেরা পেঁয়াজ বীজ চাষি সাহিদা বেগম বলেন, গত বছর আবহাওয়া অনুকূলে ছিল না। তারপরও পেঁয়াজ বীজ বিক্রি করে বেশ লাভবান হয়েছি। এ বছরও বেশি জমিতে পেঁয়াজ বীজের আবাদ করেছি। এখন পরাগায়নের কাজ চলছে। এতে বাড়তি খরচ হলেও দ্বিগুণ ফলন হবে।
পেঁয়াজ বীজের আরেক বড় চাষি বক্তার খান ফরিদপুর প্রতিদিনকে বলেন, ফলন ভালোর জন্য মৌমাছি তেমন ভূমিকা রাখে না। তবে ঝড়ো বাতাস, কুয়াশা, অতিখরা ও বৃষ্টিতে পেঁয়াজ বীজের ফলনের ক্ষতি হয়। পরাগায়নের জন্য শুধু মৌমাছির ওপর নির্ভরশীল হলেই হবে না। শ্রমিকের বাড়তি খরচ হলেও হাত দিয়ে পরাগায়ন করা হয়েছে। এতে ফলন হবে দ্বিগুণ।
ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জিয়াউল হক বলেন, এ বছর ক্ষেতে মৌমাছি না আসায় হাত দিয়ে পরাগায়ন করতে হয়েছে। এতে পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন বেশি হবে। জমিতে পোকা দমনের ক্ষেত্রে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে উপকারী পোকা এবং মৌমাছি মারা যাচ্ছে। যার কোনো সঠিক ব্যাখা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ফলন ভালোর জন্য মৌমাছির ভূমিকাই যে প্রধান, তা নয়। ঝড়-বাতাস, কুয়াশা ও বৃষ্টিতে ফলনের ক্ষতি হয়।