
দৈনিক রাজবাড়ী সময় ডেস্ক:
একজন মানুষ যখন তার চিন্তা,কর্ম, দর্শন স্বপ্ন, সময় শ্রম,মেধা সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে বড় হয়ে ওঠে। মানবতার জন্য যিনি নিবেদিত হয়ে ওঠেন।মানুষের মুক্তির জন্য যিনি থাকেন সদা দীপ্ত। সকল কুসংস্কার অন্ধকার, শৃঙ্খল থেকে মানুষের মুক্তির জন্য যিনি সংগ্রামী, মুক্তি পাগল। তিনি আর তখন একটি পরিবারের থাকেন না।তিনি হয়ে যান সমাজের দেশের রাষ্ট্রের, সকল মানুষের।তিনি তখন পরিণত হয়ে যান, জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার। এমন একজন আমাদের ঘরের পাশেই বিজন ভট্টাচার্য। রবীন্দ্রনাথের ওই বিখ্যাত উক্তি দেখা হয়নি চক্ষু মিলিয়া ঘর হইতে দু পা ফেলিয়া হ্যা ঘরের পাশেই আমাদের রাজবাড়ী জেলার খানখানাপুর এই গুণী মানুষটির জন্ম।আমাদের বিজন ভট্টাচার্য, ভারতের রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত নাট্যজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব যিনি রাজবাড়ীতে এসেছেন চার দিনব্যাপী নাট্য উৎসবের উদ্বোধক হিসেবে অতিথি হয়ে।তিনি যখন জানলেন এই রাজবাড়ীতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন খ্যাতিমান নাট্য ব্যক্তিত্ব বিজন ভট্টাচার্য। মহেশ্বতা দেবীর স্বামী। নবারুন ভট্টাচার্যের বাবা। তখন প্রবীর গুহ, বন্ধু নবারুন ভট্টাচার্যের পিতা বিজন ভট্টাচার্যের বাস্তবভিটা দেখার বাসনা প্রকাশ করলেন। সাথে ছিলাম আমি ও খানখানাপুর, বিজন ভট্টাচার্যের ঐ গ্রামেরই ছেলে সহপাঠী বন্ধু মাসুদুল ইসলাম। রাজবাড়ীর বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক জনাব নাসিম শফি, যিনি নাট্যোৎসবের ছিলেন বিশেষ অতিথি।উনি তার গাড়িতে করে বিজন ভট্টাচার্যের বাড়িতে প্রবীর গুহার সঙ্গী করে আমাদের পাঠালেন। রাজবাড়ী থেকে কামালদিয়ে হয়ে নয় দশ কিলো পথ। প্রবীরদা বাস্তভিটায় উপস্থিত হয়ে প্রথমেই ঘরের জানালাটা স্পর্শ করলেন এবং হাতটা বুকে ছুয়ালেন। হাত বুকে স্পর্শ করে চোখ বন্ধ করলেন। বললেন আমাকে আজ ধন্য মনে হয়েছে।যে ঘরে তিনি এক সময় থেকেছেন । সেই ঘরটাকে, সেই ঘরের কাঠের জানালাটাকে আমি স্পর্শ করতে পেরেছি। যে ঘরটায় উনি ছোটবেলা কাটিয়েছেন। বন্ধু মাসুদ জানালো একাত্তরের অনেক ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে লুটপাট ভাঙচুর হলেও এই ঘরটা ছিল অক্ষত। এখন তা জরাজীর্ণ উত্তর পুরুষ জ্ঞাতি শরিকেরা ব্যবহার করে। তাদের সঙ্গতি সামান্য তা ঘরের অবস্থা দেখেই বুঝা যায়।ঘরের সেই শতবর্ষি কাঠের বেড়া আর জানালা এখনো দাড়িয়ে কালের সাক্ষী হয়ে । জানালার শিকগুলো মরিচা ধরে চিকন হয়ে গেছে।
যে জানালায় আছে বিজন ভট্টাচার্যের স্পর্শ। শরীকদের মধ্য বয়সি এক মহিলা বললেন যে নবারুণ ভট্টাচার্য,বিজন ভট্টাচার্যের ছেলেও একবার এসেছিলেন গাড়ি নিয়ে অভিনেতা পিযুষ বন্দোপাধ্যায়ের সাথে। পিতৃ ভূমির বাস্তভিটায় দেখে যাওয়ার সময় এক মুষ্টি মাটি উনি নিয়ে গিয়েছিলেন। পিতার চরন স্পর্শে ধন্য মাটির মূল্য সন্তানের কাছে কত মহা মূল্যবান তা হয়ত তিনি উপলব্দি করতে পেরেছিলেন,ধন্য পিতার ধন্য পূত্র।নবারুন ভট্টাচার্য ওপার বাংলার মা বাবার মতই সংস্কৃতি অঙ্গনের এক খ্যাতিমান মানুষ।
সংস্কৃতি সচেতন এলাকাবাসী বা সরকারিভাবে উদ্যোগী হয়ে এই ঘরটি সংরক্ষণ করে, উনার জন্ম মৃত্যু দিবসে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই গুণীর প্রতি সম্মান জানান সময়ের দাবি।

বিজন ভট্টাচার্য (১৯০৬-১৯৭৮) ছিলেন নাট্যকার, অভিনেতা। তাঁর পিতা ক্ষীরোদ বিহারী ভট্টাচার্য ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক। পিতার কর্মসূত্রে বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করার সুবাদে তিনি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন; ফলে তাদের সংগ্রামী জীবন ও আঞ্চলিক কথ্য ভাষার ছাপ তাঁর রচিত নাটকে পরিলক্ষিত হয়। বিজনভট্টাচার্য অসহযোগ আন্দোলনে (১৯২০-২২) যোগ দিয়ে কারাবরণ করেন। পরে কলকাতার আশুতোষ কলেজ ও রিপন কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি জাতীয় আন্দোলনে (১৯৩১-৩২) যোগ দেন এবং মহিষবাথানে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। ফলে লেখাপড়ায় (বিএ) ছেদ পড়ে এবং ১৯৩৪-৩৫ সালের ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হিসেবে তিনি বিভিন্ন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করেন।বিজন ভট্টাচার্য কিছুদিন (১৯৩১-১৯৩২) আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করেন এবং ১৯৩৮-৩৯ সালে তিনি আলোচনা, ফিচার ও স্কেচ লেখার কাজ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথমদিকে তিনি মাতুল সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারের অরণি পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন এবং বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করতে থাকেন। ১৯৪২ সালে সক্রিয় কর্মী হিসেবে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। এছাড়া তিনি ভারত ছাড আন্দোলন, জনযুদ্ধ-নীতি প্রচার, ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক ও শিল্পিসঙ্ঘ স্থাপন এবং প্রগতি লেখক সঙ্ঘ এবং ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।নবনাট্য আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক বিজন ভট্টাচার্য গণজীবনের সংগ্রাম ও দুঃখ-দুর্দশা, শোষণ-বঞ্চনা, প্রগতিশীল চিন্তা ও সমাজবোধ নিয়ে নাটক রচনা করে এবং এ ক্ষেত্রে তিনি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। তবে তাঁর শেষজীবনে রচিত নাটকে মার্কসীয় দর্শন, হিন্দু ধর্ম ও দর্শন সংমিশ্রিত হয়েছে। তিনিই প্রথম বাংলা রঙ্গমঞ্চকে পুরাণ ও ইতিহাসের রোম্যান্টিক প্রভাব থেকে মুক্ত করেন। তাঁর প্রথম নাটক আগুন (১৯৪৩) নাট্যভারতীতে অভিনীত হয়। পরে তিনি রচনা করেন জবানবন্দী (১৯৪৩); এটি কৃষকজীবনের আলেখ্য। তাঁর প্রতিভার সার্থকতম নিদর্শন হলো নবান্ন (১৯৪৪) নাটক; বন্যা, দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর পটভূমিকায় রচিত এই নাটকে দুঃস্থ-নিপীড়িত কৃষকজীবন প্রতিফলিত হয়েছে। গণনাট্য সংঘের প্রযোজনায় নবান্ন নাটকে তিনি নিজে অভিনয় করেন এবং অন্য অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ছিলেন তৃপ্তি মিত্র, শম্ভু মিত্র, গঙ্গাপদ বসু, শোভা সেন, গোপাল হালদার প্রমুখ।
১৯৪৬ সালের দাঙ্গার পটভূমিকায় তিনি রচনা করেন জীয়নকন্যা নাটক। এছাড়া তাঁর আরও দুটি নাটক হলো মরাচাঁদ ও কলঙ্ক। মরাচাঁদ চবিবশ পরগনার এক অন্ধ গায়কের জীবনকাহিনী, আর কলঙ্ক বাঁকুড়ার সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর জীবনালেখ্য। তাঁর গোত্রান্তর (১৯৬০) নাটকের বিষয়বস্ত্ত ছিন্নমূল পূর্ববঙ্গবাসীর ভাগ্যবিপর্যয়। পরে তিনি লেখেন মুনাফাখোর মিল-মালিক ও শোষিত শ্রমিকদের নিয়ে অবরোধ (১৯৪৭)। ১৯৬৬-তে লেখেন দেবীগর্জন ও বেদেদের জীবন নিয়ে গর্ভবতী জননী। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য দুটি গল্প হচ্ছে তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত ‘জনপদ’ এবং দেশবিভাগের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘রাণী পালঙ্ক’।বিজন ভট্টাচার্য স্বপ্রতিষ্ঠিত ক্যালকাটা থিয়েটার গ্রুপে (১৯৫০) ইস্তফা দিয়ে ১৯৭০ সালে ‘কবচকুন্ডল’ নাট্যপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং শেষাবধি এর সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। তিনি চলচ্চিত্রেও দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করেন। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলি হলো: বাড়ি থেকে পালিয়ে, মেঘে ঢাকা তারা, সুবর্ণরেখা, পদাতিক, যুক্তি তক্কো গপ্পো ইত্যাদি। এছাড়া তিনি নাগিন, সাড়ে চুয়াত্তর, বসু পরিবার, তৃষ্ণা, ডাক্তারবাবু প্রভৃতি ছবির স্ক্রিপ্ট তৈরি করেন।
১৯৪৮-৫০ সময়ে বিজন ভট্টাচার্য বোম্বাই চলচ্চিত্রে অভিনয় ও ফিল্মস্ক্রিপ্ট লেখার কাজও করেন। গায়ন ও সুরযোজনায়ও তিনি পারদর্শী ছিলেন।বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে তিনি পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন, যদিও তাঁদের দাম্পত্য জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। নাট্যজগতে বিশেষ অবদানের মূল্যায়নস্বরূপ কেন্দ্রীয় সঙ্গীত নাটক আকাডেমি, পশ্চিমবঙ্গ সঙ্গীত নাটক আকাদেমি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে পুরস্কৃত করে। ১৯৭৮ সালের ১৯ জানুয়ারি কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।যারা আলো ছড়ায় তাদের বিনাশ করা যায় না।তারা বেঁচে থাকে। সময় তাদের ধারন করে। সময়ের প্রয়োজনে। রাজবাড়ী থিয়েটারের চারযুগ পূর্তিতে চার দিন ব্যাপী নাট্যোৎসবের এই সময়ে,রাজবাড়ীর মাটির এই গুণী মানুষটির প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা। তথ্যসূত্র,বাংলাপিডিয়া, লেখক ও কলামিষ্ট,মোঃআতাউর রহমান,
