
নিজস্ব প্রতিবেদক
২০০২ সালে এশিয়ার মাটিতে অনুষ্ঠেয় প্রথম বিশ্বকাপের সর্বশেষ কোনো ইউরোপীয় দলের বিরুদ্ধে জিতেছিল ব্রাজিল। এরপর থেকে আর ফুটবলের বিশ্বমঞ্চের কোয়ার্টার ফাইনালে কোনো ইউরোপীয় প্রতিপক্ষকে হারাতে পারছিল না ব্রাজিল।
অবশেষে কাতার বিশ্বকাপে এসেও সেই গেরো ভাঙতে সক্ষম হলো না ব্রাজিল। অতিরিক্ত সময়ে নেইমারের দেওয়া গোলে এগিয়ে গেলেও পরে ক্রোয়েশিয়া সমতায় ফেরায় ম্যাচ টাইব্রেকারে গড়ায়। সেখানে ব্রাজিলের রদ্রিগো আর মার্কুইনহোস লক্ষ্যভেদ করতে ব্যর্থ হন। অন্যদিকে, টানা চার শটে লক্ষ্যভেদ করে সেমিফাইনালে চলে গেল ক্রোয়েশিয়া।

প্রথম কয়েক মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর ধীরে ধীরে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেয় ক্রোয়েশিয়া। ম্যাচে গোলের প্রথম পরিষ্কার সুযোগও পায় গতবারের রানার্সআপরাই। গতিশীল এক আক্রমণের মাধ্যমে রাইপব্যাক জুরানোভিচের কাছ থেকে বল পেয়ে যান মারিও প্যালাসিচ। তবে এদের মিলিতাও তটস্থ রাখায় ক্রোট উইঙ্গারের বাড়ানো বলটি পায়ে ঠিকমতো সংযোগ ঘটাতে পারেননি ইভান পেরিসিচ।
আট মিনিট পর অবশ্য ব্রাজিলও লিড নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল ব্রাজিল। বাঁ দিক থেকে ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণভাগকে পরাস্ত করে ডি-বক্সে ঢুকে পড়েছিলেন। তবে ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গারের নেওয়া শট আটকাতে বেগ পেতে হয়নি লিভাকোভিচের। তার কয়েক সেকেন্ড আগে পেনাল্টি স্পটের কাছে ভিনিসিয়াসের শট ব্লক করেন ক্রোট ফুলব্যাক বোর্না সোসা।
প্রথমার্ধের শেষদিকে অবশ্য রিচার্লিসনকে ফাউল করায় বিপজ্জনক একটি জায়গায় ফ্রি-কিক পেয়েছিল ব্রাজিল। তবে নেইমারের নেওয়া ফ্রি-কিকটি ক্রোট গোলরক্ষক লিভাকোভিচের পরীক্ষা নিতে সক্ষম হওয়ায় গোলবিহীনভাবেই মধ্যবিরতিতে যায় দুদল

মাঝমাঠের দখল নিয়ে মূলত খেলার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেওয়ার চেষ্টা করছিল ক্রোয়েশিয়া। তবে ব্রাজিল এগিয়ে ছিল বল দখল এবং গোলের জন্য শট নেওয়ার দিক থেকে। তবে ক্রোয়েশিয়াও আক্রমণে পিছিয়ে না থাকায় প্রথমার্ধের লড়াই হয়েছিল সমানে সমান।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই অবশ্য ক্রোয়েশিয়াকে চেপে ধরেছিল ব্রাজিল। ৪৭ মিনিটে নেইমার আর রিচার্লিসন মিলে ক্রোয়েশিয়ার ডি-বক্সে ত্রাস ছড়িয়েছিলেন। মিলিতাওয়ের বাড়ানো বলে রিচার্লিসন শট নিলেও গার্ভার্দিওল সেটি ঠেকিয়ে দেন। তবে দিক পরিবর্তন হয়ে বল গোললাইন অতিক্রম করার মুহূর্তে পা দিয়ে বল ঠেকান লিভাকোভিচ।
মিনিট খানেক পর আরেকটি দারুণ আক্রমণ ছিল ব্রাজিলের। সেই আক্রমণ চূড়ান্ত রুপ নেওয়ার আগেই রেফারি খানিকটা রোমাঞ্চ তৈরি করেন। নেইমারকে দেয়া লম্বা বল ক্রোট ডিফেন্ডার আয়ত্ত্বে নিতে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দেন। রেফারি হ্যান্ডবলের সন্দেহ করেন। ভিএআর পেনাল্টি সম্ভাব্যতা বাছাই করে দিলেও হ্যান্ডবলের পক্ষে রায় দেয়নি।
৫৫ মিনিটে আবারও গোলের সুযোগ আসে ব্রাজিলের সামনে। তবে রিচার্লিসনের বাড়ানো বলটিতে নেইমার বাঁ পায়ে শট নিলেও সেটি ঠেকিয়ে দেন লিভাকোভিচ। ৬৮ মিনিটে রদ্রিগোর পাস থেকে লুকাস পাকুয়েতার প্রচেষ্টাও কর্নারের বিনিময়ে রুখে দেন ক্রোয়েশিয়ান গোলরক্ষক।
৭৬ মিনিটে আবারও গোলের দারুণ একটি সুযোগ পেয়েছিলেন নেইমার। কিন্তু লিভাকোভিচের দৃঢ়তায় এবারও বেঁচে যায় ক্রোয়েশিয়া। চার মিনিট পর রদ্রিগো আর মিলিতাওয়ের যুগলবন্দীতে আবারও গোলের সুযোগ পেয়েছিলের লুকাস পাকুয়েতা। তবে ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডারের বাঁ পায়ের শট আটকে দেন চীনের প্রাচীররূপে আবির্ভূত হওয়া লিভাকোভিচ।
৮২ মিনিটে রদ্রিগোর কাছ থেকে বল পেয়ে রিচার্লিসন হেড করেন। কিন্তু বল চলে যায় পোস্টের ওপর দিয়ে। ৮৬ মিনিটেও দারুণ এক সুযোগ নষ্ট হয় ব্রাজিলের। এডের মিলিতাওর শট ক্রোট রক্ষণভাগে প্রতিহত হয়। বদলি নামা অ্যান্টনির শট কর্নারের বিনিময়ে রক্ষা করে ক্রোয়েশিয়ান ডিফেন্ডার। চার মিনিটের যোগ করা সময়ের শেষদিকে ডান প্রান্ত থেকে অ্যান্টনির শট লিভাকোভিচ নিজের দখলে ম্যাচকে অতিরিক্ত সময়ে নিয়ে যান ক্রোট গোলরক্ষক লিভাকোভিচ।
অতিরিক্ত সময়ের ১০ মিনিট পার হওয়ার থিয়াগো সিলভার ক্রস থেকে অ্যাক্রোবেটিক কিকে গোল দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন অ্যান্টোনি। কিন্তু বলে পায়ে ঠিকমতো সংযোগ না হওয়ায় ক্রোট গোলরক্ষক লিভাকোভিচের ঠিকই বলটি নিজের আয়ত্বে নেয়। মিনিট দুয়েক পর গোলের সুযোগ এসেছিল ক্রোয়েশিয়ার সামনেও। বাঁ প্রান্ত দিয়ে দুই ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডারকে ফাঁকি দিয়ে ক্রোয়েশিয়ান ফরোয়ার্ড ব্রুনো পেতকোভিচ ডি-বক্সে প্রবেশ করেন। তিনি ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা মার্সেলো ব্রোজোভিচকে বলও বাড়ান। কিন্তু ব্রোজোভিচের নেওয়া শটটি পোস্টের ওপর দিয়ে চলে যায়।
অবশেষে ১০৫ মিনিটে ক্রোট রক্ষণের দেয়াল ভাঙেন নেইমার। ডি-বক্সের সামনে থেকে নেইমারের উদ্দেশ্যে বল ঠেলা হলে ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার দারুণভাবে আয়ত্ত্বে নিয়ে এক ক্রোট ডিফেন্ডারকে পরাস্ত করেন। ব্রাজিলের সামনে দুর্ভেদ্য দেয়াল হয়ে দাড়ানো লিভাকোভিচ এসেছিলেন নেইমারকে রুখতে। নেইমার একটু ডানে সরে গিয়ে তাকেও পরাস্ত করে ঠাণ্ডা মাথায় বল জালে পাঠান। এর মাধ্যমে জাতীয় দলের হয়ে ৭৭তম গোল করে ব্রাজিলের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতার আসনে থাকা পেলেকে ছুঁয়ে ফেলেন নেইমার নেইমারের রেকর্ড ছোঁয়া গোলের পর ব্রাজিলের সেমিফাইনালে যাওয়া সময়ের ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছিলো। তবে গোল হজমের পর পুরো ম্যাচ ব্রাজিলের রক্ষণ সামলাতে তৎপর থাকা ক্রোয়েশিয়া ম্যাচে ফিরতে ব্যাকুল হয়ে উঠলো। শেষ পর্যন্ত অতিরিক্ত সময় শেষ হওয়ার চার মিনিট আগে ম্যাচে ফিরে এলো ক্রোয়েশিয়া। মিস্লাভ ওরসিকের পাস থেকে বল পেয়ে ব্রুনো পেটকোভিকের দুর্দান্ত এক শট জড়িয়ে যায় ব্রাজিলের জালে। বাকি সময়ে দুই পক্ষের কেউই গোল না করায় ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে।পেনাল্টি শুটআউটে ক্রোয়েশিয়ার নিকোলা ভ্লাসিচ, লভরো মাইয়ের, লুকা মদ্রিচ ও মিসলাভ অরসিচ লক্ষ্যভেদ করেন। ব্রাজিলের রদ্রিগোর নেওয়া শট বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে ঠেকান পুরো ম্যাচে ১১টি সেভ করা ডমিনিক লিভাকভিচ। পরের দুই শটে ক্যাসেমিরো আর পেদ্রো গোল করায় লড়াইয়ে টিকে ছিল সেলেসাওরা। কিন্তু চতুর্থ শটে মার্কুইনোসের নেওয়া প্রচেষ্টার সঙ্গে ব্রাজিলের সেমিফাইনাল স্বপ্নও পোস্টে প্রতিহত হয়ে ফিরে আসা।এর মাধ্যমে বিশ্বকাপে পাঁচটি টাইব্রেকার পর্বের প্রতিটিতেই শেষ হাসি নিয়ে ফিরে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সেমিফাইনালে পা রাখলো ক্রোয়েশিয়া। ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে তাদের প্রতিপক্ষ আর্জেন্টিনা অথবা নেদারল্যান্ডস। অন্যদিকে, স্বপ্নভঙ্গে হতাশায় চোখে অশ্রু নিয়ে কাতার বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিল ব্রাজিল
