
নিজস্ব প্রতিবেদক ( মোঃ আনিসুর রহমান)
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের পদ্মা ও গড়াই নদের তীরবর্তী জেলা রাজবাড়ী। এই জেলার ঐতিহ্য খেজুরের গুড়ের কদর রয়েছে দেশজুড়ে। এখানে তৈরি খেজুরের পাটালি ও গুড়ের সুনাম সব মহলে। তাই শীতের আগমনী বার্তায় খেজুরগাছের রস সংগ্রহের প্রাক-প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে রাজবাড়ীর গাছিদের মাঝে।
উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে শীতের আভাস অনেক আগেই শুরু হয়েছে। তবে কিছুটা বিলম্বিত হলেও রাজবাড়ীতে ইতিমধ্যে শীতের প্রকট দেখা দিয়েছে। আবহমান গ্রামবাংলার ঐতিহ্য খেজুরের রস আহরণের জন্য গাছিরা গাছ কাটা-ঝাড়ায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। শীত কিছুটা বাড়লেই শুরু হবে রস সংগ্রহ। তৈরি হবে খেজুরের গুড়।তবে আগের মতো আর দেখা মেলে না দিগন্তজোড়া মাঠ কিংবা সড়কের দুই পাশে সারি সারি অসংখ্য খেজুরগাছ। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে খেজুরগাছ। একটা সময় ছিল, শীত মানেই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সুস্বাদু খেজুরগাছের রস পান করা। শীতের সকালে মিষ্টি রোদে বসে সুস্বাদু রস পানের মজাই আলাদা।
এখন যত্রতত্র ইটভাটা গড়ে উঠেছে। খেজুরগাছ জ্বালানি হিসেবে উত্তম হওয়ায় এবং দাম বেশি পাওয়ায় গাছের মালিকরা গাছ বিক্রি করে দেন। এ ছাড়া পরিবেশ বিপর্যয় তো আছেই। ফলে খেজুরগাছের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। তবে যা গাছ আছে, তাতে গাছিরা হাতে দা নিয়ে ও কোমরে দড়ি বেঁধে নিপুণ হাতে গাছ চাঁচাছোলা ও নলি বসানোর কাজ করছেন।রাজবাড়ী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, জেলায় মোট ৮০ হাজার ৮৩৯টি খেজুরগাছ রয়েছে। এর মধ্যে রাজবাড়ী সদর উপজেলায় ২৩ হাজার ৪৫০টি গাছ, কালুখালী উপজেলায় ১৭ হাজার ২০০টি, পাংশা উপজেলায় ২১ হাজার ১২৭টি, বালিয়াকান্দি উপজেলায় ৯ হাজার ৫১১টি ও গোয়ালন্দ উপজেলায় ৮ হাজার ৭১২টি খেজুরগাছ রয়েছে। যা থেকে এ বছর শূন্য দশমিক ৯০ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
শীত মৌসুম এলেই সর্বত্র শীত উদযাপনের নতুন আয়োজন শুরু হয়। খেজুরের রস আহরণ ও গুড় তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এ অঞ্চলের গাছিরা। তাদের মুখে ফুটে ওঠে রসালো হাসি। শীতের দিন মানেই গ্রামাঞ্চলে খেজুর রস ও নলেন গুড়ের ম-ম গন্ধ। শীতের সকালে খেজুরের তাজা রস যে কতটা তৃপ্তিকর, তা বলে বোঝানো যায় না। আর খেজুর রসের পিঠা এবং পায়েস তো মুখরোচক খাবার। এ কারণে শীত মৌসুমের শুরুতেই গ্রামাঞ্চলে খেজুর রসের ক্ষির, পায়েস ও পিঠে খাওয়ার ধুম পড়ে যায়।
সদর উপজেলার রামকান্তপুর গ্রামের গাছি রহিম মোল্লা জানান, শীতের শুরুতেই খেজুরগাছ ঝুড়ে-কেটে রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত করা হয়। এরপর দেওয়া হয় চাঁচ। পরে নলি মারার মাধ্যমে শুরু হয় রস সংগ্রহ। খেজুরের সুস্বাদু রস জ্বালিয়ে তৈরি হয় খেজুরের গুড় ও পাটালি। এই অঞ্চলের পাটালি ও ঝুলা গুড়ের কদর রয়েছে দেশব্যাপী।
বালিয়াকান্দি উপজেলার নলিয়া জামালপুরের গাছি আজিজ সরদার বলেন, বর্তমানে যে হারে খেজুরগাছ হারিয়ে যেতে বসেছে, তাতে একসময় হয়তো আমাদের এলাকায় আর এ গাছ থাকবে না। এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে চাইলে আমাদের সবার উচিত তালগাছের মতো বেশি বেশি খেজুরগাছ লাগিয়ে যত্নসহকারে বড় করা।
সদর উপজেলার মূলঘর ইউনিয়নের গাছি কামাল হোসেন বলেন, এখন আর তেমন খেজুরগাছ নাই। একটা সময় ছিল যখন আমি সিজনে প্রতিদিন ১০০ হাড়ি রস সংগ্রহ করতাম। এখন সেটা ১০-এর কোঠায় নেমে এসেছে। এ ছাড়া খেজুর গুড়ের তেমন দাম পাওয়া যায় না। যে কারণে খেজুর রসের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে ২ নম্বর গুড় তৈরি করছে অনেকেই।এই ইউনিয়নের আরেক গাছি জাফর শেখ বলেন, জেলাজুড়ে আমার তৈরি খেজুরের গুড়ের সুনাম রয়েছে। আমি অরজিনাল খেজুরের রস দিয়ে গুড়, পাটালি তৈরি করি। তবে এখন বাজারে ভেজাল গুড় ও পাটালির জন্য আমাদেরটা নিতে চায় না। কারণ, ওরা কম দামে বিক্রি করে। একটা সময় ছিল যখন শীত আসলেই মানুষ পিঠা তৈরির জন্য আমার কাছে গুড় ও পাটালি বায়না দিয়ে যেত, এখন তেমন আর আসে না।
সদর উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামের গাছি সুজন শেখ জানান, পরিবেশ বিপর্যয় আর এলাকার ভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে খেজুরগাছ ব্যবহারের ফলে গাছের সংখ্যা কমে এসেছে। আগের মতো রসও হয় না। জমির আইলে যে খেজুরগাছ ছিল তাও হারিয়ে গেছে। এখন গাছে বাঁশের খিল লাগানোর কাজ চলছে। অল্পদিনের মধ্যেই রস আহরণ শুরু হবে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে খেজুরের পরিকল্পিত আবাদ তেমন নেই। উপরন্তু নির্বিচারে খেজুরগাছ কেটে ফেলা হচ্ছে, যা পল্লিবাংলার পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। খেজুরগাছ থেকে শুধু সুমিষ্ট রস ও গুড়ই হচ্ছে না, প্রাকৃতির ভারসাম্য সুরক্ষায় খেজুর গাছের আবাদ সম্প্রসারণ জরুরি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক এস এম শহীদ নূর আকবর ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিদিন ইটভাটায় জ্বালানির কাজে নিধন হচ্ছে এলাকার শত শত খেজুরগাছ। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এরপরও আমরা এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি