রাজবাড়ী ০৩:৩৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৭ মে ২০২৫, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনামঃ
রাজবাড়ীতে চোর স‌ন্দে‌হে যুবককে পিটিয়ে হত্যা, গ্রেপ্তার ৪ রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতে ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষে বালিয়াকান্দীতে আলোচনা সভা রাজবাড়ী ট্রেনে কাটা পড়ে মাসুদ নামে যুবকের মৃত্যু রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে দুদকের অভিযান, ৩২ ডাক্তারের ১০ জনই অনুপস্থিত পরিবেশ সংরক্ষণ আইন লঙ্ঘনে গোয়ালন্দে ভিক্টর ভিলেজকে ২ লাখ টাকা জরিমানা রাজবাড়ীতে ট্রাকচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত, আহত ২ অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্তে শুরু হলো শতবর্ষী রামদিয়ায় ঐতিহ্যবাহী মদন মোহন পুষ্প রথযাত্রা ও ৩২ প্রহর ব্যাপী মহানামযজ্ঞ শতবর্ষী উৎসব যাত্রামঞ্চের মহেন্দ্র বাবু আজ জীবনমঞ্চে একাকী খোঁজ রাখেনা কেউ বিশ্ব মা দিবস হাজারীবাগ সুবিধা বঞ্চিত মানুষের উপহার প্রদান করছেন ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম। কবিতা_মা ( আতাউর রহমান)

যাত্রামঞ্চের মহেন্দ্র বাবু আজ জীবনমঞ্চে একাকী খোঁজ রাখেনা কেউ

যাত্রামঞ্চের মহেন্দ্র বাবু আজ জীবনমঞ্চে একাকী খোঁজ রাখেনা কেউ
ইমদাদুল হক রানা ঃ
“এখন আর পার্বতীর সংবাদ লইতে ইচ্ছা করে না। তবে দেবদাসের জন্য বড়ই করুনা অনুভব হয়।” — বাংলা সাহিত্যের খ্যাতনামা লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা এই সংলাপ আজ যেন বাস্তব হয়ে উঠেছে রাজবাড়ী জেলার এক গুণী যাত্রাশিল্পীর জীবনে।
রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের রামদিয়া গ্রামের শ্রী তারাপদ কর্মকার— এক সময়ের মঞ্চ কাঁপানো অভিনেতা। তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবদাস যাত্রাপালায় জমিদার মহেন্দ্র বাবুর ভূমিকায় অভিনয় করে উপমহাদেশজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আজ তিনি নিজ বাড়িতে রোগাক্রান্ত অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন, অথচ খোঁজ রাখে না কেউ।
(এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সহ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলো, যেন তারাপদ কর্মকারের মতো জীবন্ত ইতিহাসসেরা শিল্পী জীবনের শেষ পর্বে কিছু সম্মান ও সহানুভূতি পান।)
অগ্রগামী অপেরার মালিক ও অন্যতম খ্যাতিমান শিল্পী তারাপদ কর্মকার এক সময় ৬০/৭০ টি শিল্পী পরিবারের আহার যোগাতেন। তিনি অভিনয় করেছেন বহু যাত্রাদলে, বহু নাটকে। বিটিভি, একুশে টেলিভিশনের যাত্রা নাট্য অভিনয় করেছেন। দেবদাস যাত্রাপালায় জমিদার মহেন্দ্র বাবুর চরিত্রে তাঁর অভিনয় এতটাই জীবন্ত ছিল যে দর্শকের মনে তা গেঁথে আছে আজও। নাটকে তিনি ছিলেন দেবদাসের প্রতিদ্বন্দ্বী—পার্বতীকে বিয়ে করে ঘরসংসারে মত্ত, আর প্রেমে পরাজিত দেবদাস বিপথগামী। জীবন যেন অনুকরণ করেছে সেই শিল্পকেই।
১৯৫২ সালে ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলার মোষেরপোল গ্রামে জন্ম নেন তারাপদ কর্মকার। ১৯৬৮ সালে ছোট কাকা নকুল কর্মকারের হাত ধরে যাত্রার জগতে প্রবেশ করেন। প্রথম মঞ্চাভিনয় করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভোলানাথ অপেরায় সম্রাট শের শাহ্ নাটকে খলনায়কের চরিত্রে। এরপর একে একে কাজ করেন নট্ট কোম্পানি, শিল্পী তীর্থ, ভারতী অপেরা, বাসন্তি অপেরা, গণবাণী, ভৈরব অপেরা, মুক্তধারা ও অগ্রগামীতে।
তাঁর অভিনীত জনপ্রিয় যাত্রাপালার মধ্যে রয়েছে: দেবদাস, গুলি হলো মানুষের অধিকার, ধনরাজ তামাং, বিদ্যাসুন্দর, মহাজনের মেয়ে, বণিক বাড়ির বৌ, কুমারী মা, কলসি কাঁখে কুলের বধু, কলকাতার বৌদি, বড় দিদি, বৌমা তোমার পায়ে নমস্কার, থানায় যাচ্ছে ছোটো বৌ, শেষ সাক্ষী দুর্গা, কবরে কাঁদছে আনারকলি, বৃদ্ধাশ্রমে কাঁদছে বাবা মা, নবাব সিরাজউদৌলা—ইত্যাদি।

যাত্রাশিল্পে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও প্রশংসা। কিন্তু আজ এই কৃতী শিল্পী জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পড়েছেন অবহেলার অন্ধকারে। সম্প্রতি গণমাধ্যম কর্মীদের দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,
“যাত্রাশিল্পে অভিনয় করে মানুষের প্রশংসা অর্জন করলেও নিজের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারিনি।”
তিনি আক্ষেপ করে বলেন,
“দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাত্রা করে মানুষের মনে বিনোদন দিয়েছি। কিন্তু আজ নিজ জীবনেই বিনোদনের রেষমাত্র নেই। রোগাক্রান্ত হয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ভালো চিকিৎসার জন্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, শিল্পকলা একাডেমি, জেলা প্রশাসকসহ অনেক জায়গায় আবেদন করেও কোনো সহায়তা পাইনি। সেই দিনের মহেন্দ্র বাবুর খোঁজ এখন আর কেউ রাখে না।”
(এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলো, যেন তারাপদ কর্মকারের মতো জীবন্ত ইতিহাসসেরা শিল্পী জীবনের শেষ পর্বে কিছু সম্মান ও সহানুভূতি পান।)
এক সময়ের আলো ঝলমলে মঞ্চজীবনের মহানায়কের এমন করুণ বাস্তবতা আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি এক গভীর প্রশ্ন তোলে—আমরা কি ভুলে যাচ্ছি আমাদের শিকড়কে?

Tag :
সর্বাধিক পঠিত

রাজবাড়ীতে চোর স‌ন্দে‌হে যুবককে পিটিয়ে হত্যা, গ্রেপ্তার ৪

যাত্রামঞ্চের মহেন্দ্র বাবু আজ জীবনমঞ্চে একাকী খোঁজ রাখেনা কেউ

প্রকাশিত : ০৭:৫৯:৫১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১২ মে ২০২৫

যাত্রামঞ্চের মহেন্দ্র বাবু আজ জীবনমঞ্চে একাকী খোঁজ রাখেনা কেউ
ইমদাদুল হক রানা ঃ
“এখন আর পার্বতীর সংবাদ লইতে ইচ্ছা করে না। তবে দেবদাসের জন্য বড়ই করুনা অনুভব হয়।” — বাংলা সাহিত্যের খ্যাতনামা লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা এই সংলাপ আজ যেন বাস্তব হয়ে উঠেছে রাজবাড়ী জেলার এক গুণী যাত্রাশিল্পীর জীবনে।
রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের রামদিয়া গ্রামের শ্রী তারাপদ কর্মকার— এক সময়ের মঞ্চ কাঁপানো অভিনেতা। তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবদাস যাত্রাপালায় জমিদার মহেন্দ্র বাবুর ভূমিকায় অভিনয় করে উপমহাদেশজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আজ তিনি নিজ বাড়িতে রোগাক্রান্ত অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন, অথচ খোঁজ রাখে না কেউ।
(এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সহ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলো, যেন তারাপদ কর্মকারের মতো জীবন্ত ইতিহাসসেরা শিল্পী জীবনের শেষ পর্বে কিছু সম্মান ও সহানুভূতি পান।)
অগ্রগামী অপেরার মালিক ও অন্যতম খ্যাতিমান শিল্পী তারাপদ কর্মকার এক সময় ৬০/৭০ টি শিল্পী পরিবারের আহার যোগাতেন। তিনি অভিনয় করেছেন বহু যাত্রাদলে, বহু নাটকে। বিটিভি, একুশে টেলিভিশনের যাত্রা নাট্য অভিনয় করেছেন। দেবদাস যাত্রাপালায় জমিদার মহেন্দ্র বাবুর চরিত্রে তাঁর অভিনয় এতটাই জীবন্ত ছিল যে দর্শকের মনে তা গেঁথে আছে আজও। নাটকে তিনি ছিলেন দেবদাসের প্রতিদ্বন্দ্বী—পার্বতীকে বিয়ে করে ঘরসংসারে মত্ত, আর প্রেমে পরাজিত দেবদাস বিপথগামী। জীবন যেন অনুকরণ করেছে সেই শিল্পকেই।
১৯৫২ সালে ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলার মোষেরপোল গ্রামে জন্ম নেন তারাপদ কর্মকার। ১৯৬৮ সালে ছোট কাকা নকুল কর্মকারের হাত ধরে যাত্রার জগতে প্রবেশ করেন। প্রথম মঞ্চাভিনয় করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভোলানাথ অপেরায় সম্রাট শের শাহ্ নাটকে খলনায়কের চরিত্রে। এরপর একে একে কাজ করেন নট্ট কোম্পানি, শিল্পী তীর্থ, ভারতী অপেরা, বাসন্তি অপেরা, গণবাণী, ভৈরব অপেরা, মুক্তধারা ও অগ্রগামীতে।
তাঁর অভিনীত জনপ্রিয় যাত্রাপালার মধ্যে রয়েছে: দেবদাস, গুলি হলো মানুষের অধিকার, ধনরাজ তামাং, বিদ্যাসুন্দর, মহাজনের মেয়ে, বণিক বাড়ির বৌ, কুমারী মা, কলসি কাঁখে কুলের বধু, কলকাতার বৌদি, বড় দিদি, বৌমা তোমার পায়ে নমস্কার, থানায় যাচ্ছে ছোটো বৌ, শেষ সাক্ষী দুর্গা, কবরে কাঁদছে আনারকলি, বৃদ্ধাশ্রমে কাঁদছে বাবা মা, নবাব সিরাজউদৌলা—ইত্যাদি।

যাত্রাশিল্পে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও প্রশংসা। কিন্তু আজ এই কৃতী শিল্পী জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পড়েছেন অবহেলার অন্ধকারে। সম্প্রতি গণমাধ্যম কর্মীদের দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,
“যাত্রাশিল্পে অভিনয় করে মানুষের প্রশংসা অর্জন করলেও নিজের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারিনি।”
তিনি আক্ষেপ করে বলেন,
“দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাত্রা করে মানুষের মনে বিনোদন দিয়েছি। কিন্তু আজ নিজ জীবনেই বিনোদনের রেষমাত্র নেই। রোগাক্রান্ত হয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ভালো চিকিৎসার জন্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, শিল্পকলা একাডেমি, জেলা প্রশাসকসহ অনেক জায়গায় আবেদন করেও কোনো সহায়তা পাইনি। সেই দিনের মহেন্দ্র বাবুর খোঁজ এখন আর কেউ রাখে না।”
(এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলো, যেন তারাপদ কর্মকারের মতো জীবন্ত ইতিহাসসেরা শিল্পী জীবনের শেষ পর্বে কিছু সম্মান ও সহানুভূতি পান।)
এক সময়ের আলো ঝলমলে মঞ্চজীবনের মহানায়কের এমন করুণ বাস্তবতা আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি এক গভীর প্রশ্ন তোলে—আমরা কি ভুলে যাচ্ছি আমাদের শিকড়কে?