
বরেণ্য চিত্রশিল্পী মনসুর উল করিম স্মরণে
যশস্বী শিল্পী মনসুর উল করিম। জন্ম চৌদ্দ জুলাই ১৯৫০-মৃত্যু ৫ অক্টোবর ২০২০।পৈতৃক নিবাস ছিলো রাজবাড়ী জেলার কালুখালী উপজেলার কালীকাপুরে।গ্রামটির পাশেই প্রবাহমান চন্দনা নদী।গ্রামীন প্রকৃতি,নদী, সমতলের বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, উপরে বিশাল নীল আকাশ,আলো ছায়ার খেলা, প্রকৃতির রঙ-রূপের বাহার ,সৌন্দর্য সবকিছুই শিল্পীকে দারুণ ভাবে আকৃষ্ট করেতো।
শিল্পীর জীবনে নান্দনিক এ প্রকৃতির প্রভাব ছিলো গভীরতর। শৈশবের বেড়ে উঠা সময়ের কিছুটা অংশ কেটেছে এখানে।সুখময় উপভোগ্য সময়ের স্মৃতিচারণে আপ্লূত হতে দেখছি বহুবার। চন্দনায় অবগাহন করেছেন, দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠে শুয়ে নীল আকাশের
পানে চেয়ে থেকেছেন। আকাশের বিশালত্বের কাছে তাঁর নিজেকে অনেক ক্ষুদ্র মনে হয়েছে। শৈশবে যােগাযোগ ব্যবস্থা ছিলোনাজুক।পায়েচলা মেঠো পথে বাহন বলতে ছিলো ঘোরার গাড়ী,গরুর গাড়ী। ষাটের দশকের সর্বত্র অনুন্নত ব্যবস্থায় জীবনযাত্রা সহসাধ্য ছিলোনা মোটেও। শিশু মন কৌতুহলী। চারপাশে যা দেখে তার সবই তার কাছে নতুন।তাই প্রশ্ন জাগে মনে।প্রশ্নের সমাধান হাতরে ফেরে।শিল্পীর ক্ষত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নাই।তিনি রঙের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। ছবি আঁকার প্রতি তার দারুণ ঝোঁক ছিলো।তখন হাতের কাছে সবকিছু এত সহজলভ্য ছিলো না।খুব কষ্ট করেই যোগার করতে হতো।প্রকৃত প্রতিভা কখোনই কোন কিছুর অভাবে থেমে থাকে না,এটি পাহাড়ের বরফাচ্ছাদিত অন্ধকার প্রকোষ্ঠের মতই।একবার সূর্যের স্পর্শ পেলে গলতে শুরু করে এবং আঁকা বাঁকা পথ বেয়ে যে কোন প্রকারে সমতলে পৌঁছায়, সরস করে ভুমি এবং সাগরে মেশে।।তেমনি বিরল প্রতিভার অধীকারী দীপ্তীময় ব্যক্তৃিত্ব শিল্পী মনসুর উল করিমের চিত্র শিল্পের জগতে প্রবেশ এবং খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছানোয় রয়েছে জীবনের নানা বাঁকে চলা। তিনি প্রকৃতি থেকে রং সংগ্রহ করে ছবি আঁকতেন।পুঁই মাচার পাকা পুঁই ফল লাল রঙ হিসেবে ব্যবহার করছেন।কালো রং সংগ্রহের আধার ছিল হাঁড়ি পাতিল,কড়াই এর নীচে জমে থাকা কালি।গাছের সবুজ পাতার রস থেকে সবুজ রঙ ছবি আঁকার কাজে লাগাতেন।আবার এগুলোর একটি রং এর সাথে আরেকটি মিশিয়ে অন্য একটি রং ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর ছবিতে ।চুনের সাথে হলুদ মিশিয়ে বাসন্তী রং তৈরী করেছেন। বাংলার সবুজ শ্যামল প্রকৃতির দানই ছিলো শিশু বয়সে ছবি আঁকার হাতেখড়ির উপকরণ।শৈশবের একটি পর্যায়ে রাজবাড়ীতে চলে আসেন।এখানে এসে তার সখ্য গড়ে উঠে পদ্মার সাথে।পদ্মা কোন মানবী নয়। রাজবাড়ীর কোল ঘেঁষে নিত্য বহমান এক নদী।নদী আর নরীতে আকর্ষণ সহজাত। তাই নারীরূপী প্রমত্ত পদ্মার রূপ আন্দোলিত করেছে তাঁর মনোজগত।শিল্পীর শিল্প বৈভবের সমৃদ্ধির পশ্চাতে নিরব নিবিড় বন্ধু ছিলো রুপসী বাংলারআলো-হাওয়া,নদী-জল,পাহাড়- সমতলের অবারিত প্রান্তর। তার মনের গভীর উপলব্ধীবোধ থেকে তিনি তার চিত্র কর্মের নাম দিয়েছেন পদ্মা পুরান,মৃত্তিকার নানা কথা প্রভৃতি।তিনি একজন জন্মগত জাতশিল্পী।যাঁর ছবি আঁকার হাতে খড়ির কোন শিক্ষক জীবনের প্রভাত বেলায় মেলেনি।তাই বলে তৃষিত ব্যাকুল মন থেমে থাকেনি পথ করে নিয়েছেন একাই, সামনে এগিয়ে গেছেন নিজের আপন ভুবনে অবাধ বিচরণের মাধ্যমে।আমার দেখা শিল্পী মনসুর উল করিম : -শিল্পীকে আমি প্রথম দেখি ১৯৬৮ সালে ছবি আঁকায় মত্ত অবস্থায়।আমি সবে মাত্র ক্লাস থ্রিতে।উৎসুক দৃষ্টিতে দেখছিলাম কাচারি ঘরে বেশ কিছু বন্ধু বান্ধব পরিবেষ্টিত হয়ে ছবি আঁকছেন।সম্ভবত তিনি তখন কলেজে প্রথম অথবা দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ১৯৬৮ সন,আমার স্মৃতিতে আজো উজ্জল।তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দী কারাগারে।ছোট বয়সের ধারণা গুলো বড়ো হয়ে স্পষ্ট হয়।মনে পড়ে ঐ দিনের আঁকা দুটি পোস্টার।ছবি দুটির বিশেষত্ব আমার মনে গেথে আছে। আয়ুব বিরোধী আন্দোলন দানা বেধে উঠেছে। একটি পোস্টারে আইয়ুব খান চেয়ারে বসে আছেন আর মুনায়েম খান নীচে বসে পায়ে তেল মালিশ করছেন।ছবির ক্যাপসন ছিলো আইয়ুব মোনায়ম দুই ভাই, এক দরিতে ফাঁসি চাই। ছবিতে তখনকার রাজনৈতিক বাস্তবতা উঠে এসেছে।ঐ সময়ে মুনায়েম খানকে ঘিরে একটি প্যারোডি গানের আংশিক মনে আছে।গানটি হলো ” শোনেন শোনেন জাঁহাপনা, শোনেন বলি ছয়জনা, বটতলার এক উকিল ছিল নাম ছিল তার মুনায়েম খাঁ———–আইয়ুব খানের পা ধইরা হইয়া গেলো গভর্নর।।”আর একটি পোস্টারে আঁকা ছিলো বাংলার একদল দারিদ্র্য পীড়িত ভূখা মানুষের ছবি।পাকিস্তান সেনারা রাইফেল তাঁক করে আছে।ছবিটির ক্যাপসন” ছিলো বুলেট না খাবার দে”।বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ে ছাত্র সমাজের অগ্রণি ভূমিকা আমি দেখেছি।ছবি কথা বলে, ছবির নিজস্ব ভাষা আছে।ছবি চেতনা আকাশে ঝড় তুলতে পারে,বিপ্লবের ভাষা হতে পারে, মুখে নয় ছবি কথা বলে ছবির নিজস্ব ভাষায়। রংতুলির শৈল্পিক কারুকাজে উঠে আসে দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য, প্রেম,প্রকৃতি, সফলতা ব্যর্থতা,একটি জাতির সৌর্যবীর্য ইত্যাদি নানামাত্রিক চিত্র।ছবি একটি সময়কে রিপ্রেজেন্ট করে, ইতিহাস ঐতিহ্য কে ধারণ করে।বোধের উন্মেষ ঘটায়।প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর রয়ে যায় শেকড়ের বিস্তার ।ছোট্ট বয়সে যা ছিলো অস্পষ্ট ক্রমে তা পরিণত হয়।তাই অনুভব করা যায় রং তুলি মন রাঙায়,বিষন্ন প্রহরের সাথী হয়,বিপ্লবী চেতনার শাণিত প্রকাশ ঘটায়। তাই শিল্পী মনসুর উল করিমের আঁকা সেই পোস্টার গুলো আমার ছোট্ট মনে দাগ কেটেছে। শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন – উৎপীড়নে শিল্পীর হাতের রংতুলিও গর্জে উঠে,অধিকার আদায়ে রুখে দাঁড়ায়, দৃঢ় প্রত্যয়ী হতে সাহস যোগায় এবং জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে অনেক বেশি ভূমিকা রাখে।তাই শিল্পী মনসুর উল করিম আমার দৃষ্টিতে একজন সংগঠক, ন্যায়ের পক্ষে ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামী বিপ্লবী তরুণ।
শিল্পী মনসুর উল করিম এর ছবির দর্শন মননশীল চর্চা চিত্রশিল্পের জগতে এক অনন্য মাত্রা যোগ করেছে।ছাত্রাবস্থায় পাড়াতে যত অনুষঠান হয়েছে, বিদ্যালয়ে সব ডেকোরশনে তার শিল্পীত হাত ছিলো। চিত্র কর্ম নিয়ে কাজ করলেও জীবনের অন্য বাঁকে তার প্রতিভার স্ফূরণ দেখতে পাই। তিনি কবি ও লেখক।তার প্রকাশিত গ্রন্থ — লেখা ও রেখা। ভালো হকি খেলোয়ার ছিলেন।
গায়ের রং কালো হওয়ায় তিনি রাজবাড়ীতে কালা ভাই

নামে পরিচিত ছিলেন।
ঢাকা ফাইন আর্টস থেকে গ্রাজুয়েশন কররার পর শিল্পী রশিদ চৌধুরীর আমন্ত্রনে চিটাগাং আর্ট ইনিস্টিউটে ভর্তি হন।পরবতীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। দীর্ঘ চল্লিশ বছর সেখানে অধ্যাপনা শেষে অবসরে চলে আসেন মাটির টানে রাজবাড়ীতে।এখানে শহর থেকে অনতিদূরে রায়নগরে” বুনন আর্ট স্পেস” নামে একটি প্রতিষ্টান গড়ে তুলেছেন। প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর নানন্দিকতায় ভরপুর এই প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণ। তার জীবদ্দশায় শিশুদের জন্যে নানা শিক্ষা মূলক আয়োজন করছেন, যশস্বী শিল্পী সাহিত্যিকের আগমন ঘটেছে, এখানে। শিল্পী হাশেম খান,
আব্দুল্লাহ খালিদ,রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী ফাহিম হোসেন প্রমুখ আরো অনেক খ্যাতিমান কবি, লেখক সংগীত ও চিত্র শিল্পীরা এসে সমৃদ্ধ করে গেছেন রাজবাড়ীর শিক্ষা ও সংস্কৃতির অঙ্গন। সম্মাননা প্রদান করে শিল্পীদের যযার্থ সম্মান প্রদর্শন করেছেন।শিল্প সংস্কৃতির সংকট উত্তরণে তাঁর কর্মময় ভূমিকা প্রশংসনীয়। তিনি শিল্পী রশীদ চৌধুরীর প্রতি ভালোবাসা শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ ” রশিদ চৌধুরীর স্মৃতি পরিষদ” গঠন করেছিলেন এবং তাঁর জন্ম মৃত্যু দিবসে নানা মাত্রিক আয়োজন করতেন।


একজন বিকশিত অনন্য বক্তিত্ব প্রতিভাবান এই শিল্পীর চিত্র কর্ম নিজ দেশের গন্ডি পেরিয়ে আর্ন্তজাতিক মহলেও সমাদৃত।তিনি দেশ ও দেশের বাইরে চিত্র প্রদর্শনীতে অংশ গ্রহণ করে অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এবং দেশের জন্যে সম্মান বয়ে এনেছেন। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকারের সম্মান সূচক পুরস্কার একুশে পদকপ্রাপ্ত হন। শিল্পী অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে জীবনের শেষদিন পর্ন্ত ছবি এঁকেছেন। –২০২০ সালে করোনা আক্রান্ত হয়ে ঢাকা ইউনাইটেড হাসপাতালে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
রচনায়:-আজিজা খানম
প্রাক্তন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা
লেখক ও কবি।
